সোনালি স্বপ্নে ভাসছেন নওগাঁর আম চাষিরা
পোস্ট করেছেন: মতপ্রকাশ ডেস্ক | প্রকাশিত হয়েছে: ২৪/০৩/২০২২ , ১০:৫৫ অপরাহ্ণ | বিভাগ: জেলা সংবাদ,প্রধান সংবাদ

আব্দুল মান্নান, নওগাঁ প্রতিনিধি: শস্য ভান্ডার খ্যাত ঠাঠা বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত উত্তরের জেলা নওগাঁ। ধানের পাশাপাশি এই জেলা এখন সারাদেশে আমের নতুন রাজধানী হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। আম চাষ লাভজনক হওয়ায় দিন দিন বাড়ছে আমের চাষাবাদ। এ জেলার সাপাহার ও পোরশা উপজেলা বর্তমানে চারিদিকে আমের মুকুলের গন্ধে বাতাস সুরভিত হয়ে উঠেছে, বাতাসে এখন ম-ম গন্ধ। যেদিকে দৃষ্টি যায় গাছে গাছে মুকুল আর মুকুল। বাগানে বাগানে হলুদ-সবুজের সমারোহ। মুকুলের ভারে নুয়ে পড়েছে আমের শাখা। মুকুলের মৌ মৌ গন্ধে সোনালি স্বপ্নে ভাসছেন আম চাষিরা। বাগানের সারি সারি গাছে সুরভিত মুকুলের গন্ধ পাল্টে দিয়েছে এ অঞ্চলের বাতাস। আর আম গাছ পরিচর্যায় ব্যস্ত রয়েছেন এ অঞ্চলের আম চাষীরা।
এ জেলায় প্রতি বছর দেড়-দুই হাজার হেক্টরেরও বেশি জমিতে নতুন নতুন আম বাগান গড়ে উঠছে। মাটি বৈশিষ্ট্যগত (এঁটেল মাটি) হওয়ার কারণে নওগাঁর আম সুস্বাদু হওয়ায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ এলাকার আমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আম উৎপাদনের বৃহৎ এই জেলায় কোন প্রকার আম গবেষণা কেন্দ্র এবং আম সংরক্ষণাগার না থাকায় নায্য মূল্য পাচ্ছেন না আম চাষিরা। আম চাষিদের দাবী জেলায় গবেষণা কেন্দ্র এবং আম সংরক্ষণাগার স্থাপনের।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ সূত্রে জানা গেছে, নওগাঁর পোরশা, সাপাহার, বদলগাছী, পত্নীতলা, মান্দা, ধামইরহাট, নিয়ামতপুর ঠাঠা বরেন্দ্রভূমি হিসেবে পরিচিত। এ অঞ্চলে পানির স্তর মাটির অনেক নিচে হওয়ায় বছরের বেশির ভাগ সময় ধরে জমি পতিত থাকে। বর্ষ মৌসুমে ঠাঠা এ অঞ্চলের অধিকাংশ জমিতে শুধু মাত্র আমন ধান চাষ হয়ে থাকে। ধানের চেয়ে আম চাষ বেশি লাভজনক হওয়ায় নওগাঁর ১১টি উপজেলার মধ্যে ঠাঠা বরেন্দ্রভূমির এ সব অঞ্চলে দিনদিন শতশত বিঘা জমিতে উন্নত (হাইব্রিড) জাতের আম বাগান গড়ে উঠছে। গত ৮-১০ বছর আগে জেলায় মাত্র ৬ হাজার হেক্টর জমিতে আম চাষ করা হতো। গেল বছর ২৫ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে আম চাষ করা হয়। এ বছর জেলায় প্রায় ২৯ হাজার ৫শ হেক্টর জমিতে আম চাষ করা হয়েছে। নওগাঁর আম সুস্বাদু হওয়ায় গত ছয় বছর থেকে বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে। এবার হেক্টর প্রতি গড় ফলন ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ৫০ মেট্রিক টন। আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৪৩৫ মেট্রিক টন। যার বিক্রয় মূল্য ধরা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৮৪২ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এছাড়াও গতবারের চেয়ে জেলায় এবার ৩ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে আমচাষ বেশি হওয়ায় উৎপাদন অন্য যে কোনো সময়ের রেকর্ড ভাঙবে বলে মনে করছেন কৃষি বিভাগ।
জেলার একাধিক বাগান মালিকের সাথে কথা বলে জানাগেছে, মাঘের প্রথম সপ্তাহ থেকে আম গাছে মুকুল আসতে শুরু করেছে। এখন বাগানের সব গাছ মুকুলে ভরে গেছে। এর মধ্যে অনেক গাছেই আমের গুটি আসা শুরু হয়েছে। এসব বাগানে তারা আম্রপলি, গোপালভোগ, ল্যাংড়া, ফজলি, ক্ষিরসাপাতি, বারি-৪, আশ্বিনা, হাঁড়িভাঙাসহ আরও বেশ কয়েকটি জাতের আম গাছ লাগিয়েছেন। মুকুল আসার পর থেকেই গাছের পরিচর্যা শুরু করে দিয়েছেন তারা। পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে মুকুল রক্ষার জন্য কৃষি বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে ওষুধ স্প্রে করছেন চাষিরা।
বাগান মালিকেরা আরও জানান, আবহাওয়া এখনও অনুকূলে রয়েছে। গত কয়েকদিন আগের বৃষ্টিপাত ও হালকা বাতাসে মুকুলের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। বরং উপকার হয়েছে। বৃষ্টির পানিতে মুকুল আরও শক্ত হয়েছে। আবহাওয়া এরকম থাকলে ফলন বাম্পার হবে বলেও আশা করছেন বাগান মালিকেরা।
সাপাহার উপজেলার আম চাষি ও ব্যবসায়ী খাইরুল ইসলাম জানান, আম বাগানে বছরে ৯/১০বার কীটনাশক স্প্রে করা লাগে। আম চাষ লাভজনক পেশা, খরচ খুবই সীমিত । জেলার মধ্যে বিশেষ করে সাপাহার ও পোরশা অঞ্চলের মাটি এঁটেল হওয়ায় আম অনেক সুস্বাদু এ কারনে সারাদেশে পোরশা ও সাপাহারের আমের চাহিদাও বেশি। এ অঞ্চলের আম রাজধানীসহ সারাদেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হয়ে থাকে।
জেলার পোরশা উপজেলার আম বাগান মালিক মজিদুর রহমান (পিন্টু) বলেন, এবার বাগানে বিপুল পরিমাণ মুকুল এসেছে। বর্তমানে আমার ২৫বিঘা আমরে বাগান রয়েছে অনেক গাছে গুটিও আসতে শুরু করেছে। গুটি দেখে মনে হচ্ছে এবার ফলনও ভালো হবে।
রফিকুল ইসলাম নামে আরেক আম চাষি বলেন, প্রতি বিঘাতে সার, সেচ, ওষুধ, শ্রমিকসহ খরচ পড়ে প্রায় ৩০-৩৫হাজার টাকার মত। যদি এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকে, দাম ভালো পাওয়া যায় তবে বিঘা প্রতি সব খরচ বাদ দিয়ে দেড়-দুই লাখ টাকার মত লাভ হবে।
এছাড়া কোন প্রকার রাসায়নিক দ্রব্য ছাড়াই আম বাজারজাত করা হয়ে থাকে এমনটি জানালেন এ অঞ্চলের আম চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামছুল ওয়াদুদ জানান, জেলায় প্রতি বছর হাজার হাজার টন আম উৎপাদন হলেও পাইকারি বাজার না থাকায় আম কম মূল্যে বিক্রি করে দেন চাষিরা। গত ১০ বছর আগে জেলা মাত্র ৬ হাজার হেক্টর জমিতে আম চাষ করা হতো। আম চাষিদের কৃষি বিভাগ থেকে সব সময় পরামর্শ দেয়ায় চলতি বছর জেলায় প্রায় সাড়ে ২৯ হেক্টর জমিতে আম চাষ করা হয়েছে। প্রতি বছর গড়ে দুই হাজার হেক্টররেরও বেশি জমিতে আম বাগান গড়ে উঠছে। নওগাঁর আম সুস্বাদু হওয়ায় গত কয়েক বছর থেকে সল্প পরিমান বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। কিন্তু এবার আম রফতানির সকল নির্দেশনা মেনে অধিক পরিসরে আম বিদেশে রফতানির চিন্তা করা হচ্ছে।
আগামী বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এ অঞ্চল থেকে প্রায় ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৪৩৫ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হবে বলে আশা করছেন কৃষি বিভাগসহ সংশ্লিষ্টরা।