মত প্রকাশ ও বাক স্বাধীনতা
পোস্ট করেছেন: মতপ্রকাশ ডেস্ক | প্রকাশিত হয়েছে: ২৬/০৩/২০১৮ , ৭:২৫ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: সম্পাদকীয়

মোহাম্মদ শাব্বির হোসাইনঃ আজ থেকে নতুন আঙ্গিকে নতুন কলেবরে নতুন মালিকানায় প্রকাশ হচ্ছে ”দৈনিক মত প্রকাশ”। বর্তমান জামানায় মত প্রকাশ বা বাক স্বাধীনতা এমন একটি বহুল প্রচারিত টার্ম, যা মানুষকে স্বস্তিও দিতে পারে আবার বিড়ম্বনায়ও ফেলতে পারে। সুতরাং, শুরুতেই এ ব্যাপারে কিছু জেনে নেয়া যাক। আসলে মত প্রকাশ বা বাক স্বাধীনতা বলতে কি বুঝায়? যে কোনো মতই কি আমরা প্রকাশ করতে পারি বা করি? কিংবা বাক স্বাধীনতার ক্ষেত্র কতটুকু? শিক্ষিত তো নয়ই বরং বেশির ভাগ অশিক্ষিত মানুষও স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারে না বা করে না। হিউম্যান ব্রেইনো বাই ডিফল্ট এক ধরণের প্রোগ্রাম ইনস্টল করা আছে যা আমাদেরকে সব সময় সব জায়গায় সব কথা বলার ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করে। অন্যভাবে বলা যায়, প্রত্যেক মানুষের ভেতরেই বিবেক নামক একটা স্বত্ত্বা আছে যা মানুষের চাহিদা মোতাবেক যা খুশি তাই বলাকে বাধা প্রদান করে বা সিস্টেমকে ক্ষণিকের জন্য হ্যাং করে দেয়। আসলে যেটাই ঘটুক না কেনো তা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত মানুষের জন্য বিশেষ একটা নিয়ামত। যদি তা না থাকতো তাহলে কি হতো সেটা আমরা চোখ বন্ধ করে চিন্তা করলেই দেখতে পাই। তার মানে আবার এই নয় যে এমন মানুষ পৃথিবীতে নাই। আছে, আপনার আমার পাশেই আছে। আমরা তাদেরকে বলি আহাম্মক, বলি ব্যাটার হুঁশ-বুদ্ধি নাই নাকি? কোথায় কি বলতে হয় তাও জানে না? আর এক ধরণের মানুষ আছে, যারা যা মনে আসে তাই বলে, কোনো রাখঢাকও নাই আবার বাছ-বিচারও না। এদেরকে আমরা বলি পাগল বা উন্মাদ। আসলে বাক স্বাধীনতা হলো সর্বস্তরের মানুষের কথা বলা, বক্তৃতা-বিবৃতি, মতামত বা ধারণা প্রকাশের একটি মৌলিক মানবিক অধিকার। মানুষ যা চিন্তা করে তা বাধাহীনভাবে বলতে পারার নামই বাক স্বাধীনতা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা। বাক স্বাধীনতার প্রাথমিক ধারণাটি মানবাধিকার সম্পর্কিত প্রাচীন নথিপত্রেও পাওয়া যায়। ১৯৪৮ সালে আন্তর্জাতিকভাবে এ অধিকারটি মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার (Universal Declaration of Human Rights) আর্টিকেল-১৯ এর মাধ্যমে গৃহীত হয়, যা নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি (International Covenant on Civil and Political Rights-ICCPR) কর্তৃক স্বীকৃত। তাহলে কি আছে ঐ আন্তর্জাতিক ঘোষণায়? চলুন, দেখে নেয়া যাক। প্রত্যেকেরই কোনো রকম হস্তক্ষেপ এবং বাধা ছাড়াই স্বাধীনভাবে যে কোনো মত পোষণ এবং প্রকাশের অধিকার থাকবে। আরো থাকবে যে কোনো ধরণের সীমানা পেরিয়ে সব ধরণের তথ্য ও ধারণা চাওয়া, পাওয়া এবং তাতে অংশ নেয়ার অধিকার, তা তার পছন্দের যে কোনো মিডিয়ার মাধ্যমে হতে পারে, যেমন: মৌখিক, লিখনি, মুদ্রণ, অংকন ইত্যাদি। তবে ঐ ঘোষণাতেই আবার এ ব্যাপারে কিছু নিয়ন্ত্রণ ও নিষেধাজ্ঞার কথাও রয়েছে। যেমন: ১. বিশেষ কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন (রাষ্ট্রীয়, আঞ্চলিক, সামাজিক নেতৃত্ব এ সীমা নির্ধারণ করবে) ২. অন্যের অধিকার, খ্যাতি ও সম্মান সুরক্ষার ক্ষেত্রে ৩. জাতীয় নিরাপত্তার বিবেচনা ৪. নাগরিক সুশৃঙ্খলা সংরক্ষণ ৫. জনস্বাস্থ্য ও ৬. নীতিশাস্ত্র (ধর্মীয় বিশ্বাস, সংস্কৃতি, কল্যাণকর সামাজিক রীতি-নীতি ইত্যাদি) সেখানে আরো উল্লেখ আছে যে, এই স্বাধীনতার নামে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, অসামাজিকতা ও পর্ণোগ্রাফির অবাধ প্রচারের সুযোগ থাকবে না। কারো প্রতি বা কোনো বিষয়ে ঘৃণা প্রকাশের মাত্রারও সীমা অতিক্রম করা যাবে না। তাহলে বাক স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে যখন যা খুশি তাই বলা, মত প্রকাশ করা বা প্রচার করা কিংবা কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার সুযোগ কি আছে? অথচ ইদানিং প্রায়ই লক্ষ্য করা যায় ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ব্লগে নানা রকম অশ্লীল ও আপত্তিজনক মন্তব্যও লেখা হচ্ছে মুক্ত চেতনার নামে। আসলে মুক্ত চেতনা কি কাউকে বা কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার চেতনা? বরং মুক্ত চেতনা তো হওয়া উচিত যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। তাহলে ধারাবাহিকভাবে ইসলাম, কুরআনি, মুহম্মদ (সঃ) এর বিরুদ্ধে বিষোদগারের হেতু কি? আর যারা এ জাতীয় কাজ করছে তারা বেশিরভাগই অমুসলিম কিংবা অঘোষিত বা স্বঘোষিত নাস্তিক। তাহলে প্রশ্ন দেখা দেয়, একজন অমুসলিম কুরআন সম্পর্কে কতটুকু জ্ঞান রাখে? যতটুকু জানে তা দিয়ে কি এ রকম বিদ্বেষপূর্ণ কথা বলা যায়? তাহলে মানবাধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ঘোষণাটি কি ঠিক থাকলো? আসলে এ ব্যাপারে আমাদের মুসলিমদেরও এক প্রকার ব্যর্থতা আছে। যারা আজ ইসলাম বিদ্বেষী কথাবার্তা বলছে, আমরা পারিনি তাদের সামনে ইসলামের সৌন্দর্য, সাহাবায়ে কেরামদের আমল ইত্যাদিকে তুলে ধরতে।
আমরা যদি দাওয়াতের কাজ যথাযথভাবে করতে পারতাম তাহলে সম্পূর্ণ চিত্র নিশ্চিতভাবেই ভিন্ন হতো। তারাও জানতে পারত ইসলামের শ্বাশত রূপ, মাধুর্য, সৌন্দর্য ও সহনশীলতার বিষয়। তখন তারা আর এ জাতীয় মন্তব্য করতে পারত না। এবার দেখা যাক, বাক স্বাধীনতার ব্যাপারে ইসলাম কী বলে। বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না গিয়ে শুধু কুরআন ও হাদীসের কিছু বাণী এবং খোলাফায়ে রাশেদাইনেসর ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। • হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বলো। (সূরা আহযাব: ৭০) • যারা…পারস্পরিক পরামর্শক্রমে কাজ করে। (সূরা আশ-শূরা: ৩৫-৪৩) • নিশ্চিত সাফল্য তাদের … যারা বাজে কাজ ও কথা থেকে দূরে থাকে। (সূরা মু’মিনূন: ৩) • ‘রহমান’ এর বান্দাহ তো তারাই … যারা কোনো বাজে কাজ বা কথার সম্মুখীন হলে নিজেদের মর্যাদার সাথে তা পরিহার করে চলে। (সূরা ফুরকান: ৭২) • তারা যখন অবাঞ্ছিত ও বাজে কথাবার্তা শুনে, তখন তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে: ‘আমাদের জন্যে আমাদের কাজ এবং তোমাদের জন্যে তোমাদের কাজ। তোমাদের প্রতি সালাম। আমরা অজ্ঞদের সাথে জড়িত হতে চাই না।’ (সুরা কাসাস: ৫৫) • আল্লাহ কোনো মন্দ বিষয় প্রকাশ করা পছন্দ করেন না। তবে কারো প্রতি জুলুম হয়ে থাকলে সে কথা আলাদা। (সূরা নিসা: ১৪৮) • যখন দুই ফেরেশতা ডানে ও বামে বসে তার কার্যকলাপ সংরক্ষণ করে। সে যে কথাই উচ্চারণ করে, তাই সংরক্ষণ করার জন্যে তার কাছে সদা প্রস্তুত পর্যবেক্ষক রয়েছে! (সূরা ক্বাফ: ১৭-১৮) • আবু হুরাইরা (রা:) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন: আল্লাহ ও পরকালে যে বিশ্বাস করে – তার উচিত ভাল কথা বলা অথবা চুপ থাকা। (বুখারী ৬০১৮, মুসলিম ৪৭) • উকবা ইবন আমির (রা:) জিজ্ঞেস করলেন: হে রাসূলুল্লাহ (সা:)! মুক্তি কি জিনিস? তিনি বললেন: তোমার জিহবাকে নিয়ন্ত্রণ করো…। (তিরমিযী ২৪০৬) • মুয়ায (রা:)কে ইসলামের কিছু বিধি-বিধান শিক্ষা দেয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা:) তাঁকে বললেন: আমি কি তোমাকে এর সবকিছুর মূলভিত্তি কি – তা বলবো না? তিনি বললেন: অবশ্যই হে রাসূলুল্লাহ (সা:)! মহানবী (সা:) তাঁর নিজের জিব স্পর্শ করে বললেন: এটিকে নিয়ন্ত্রণ করবে! (তিরমিযী ২৬১৬) ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:) একবার তাঁর প্রদত্ত খুতবায় বলেন, ‘হে লোকসকল ! আমি তোমাদের শাসক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছি, আমি তোমাদের সর্বোত্তম ব্যক্তি নই ; আমি যদি ভাল করি, তবে তোমরা আমায় সহযোগিতা কর। যদি ভুল করি, তবে আমাকে শুধরে দিও। আমি তোমাদের ব্যাপারে যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ্র আনুগত্য করব, তোমরাও আমার আনুগত্য করবে। আর যদি অবাধ্য হই, তবে তোমাদের দায়িত্ব নয় আমার আনুগত্য করা।’ বর্ণিত আছে, একবার জনৈক ব্যক্তি হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা:) কে লক্ষ্য করে বলল, হে আমীরুল মোমিনীন ! আল্লাহ্কে ভয় করুন ! এ সময় অপর এক ব্যক্তি তাকে বাধা দিল। তার কাছে কাজটি গর্হিত বলে মনে হলো। হযরত উমর বললেন, তাকে বলতে দাও। তোমরা যদি এরূপ না বল, তবে তোমাদের মাঝে কোন কল্যাণ থাকবে না। আর আমরা যদি তা শ্রবণ না করি, তবে আমাদের মাঝেও কোন কল্যাণ থাকবে না। অন্য এক দিনের ঘটনা। খলিফা হযরত উমর (রা:) মসজিদে নববীতে খুতবা দেয়ার সময় এক সাহাবীর প্রশ্ন: আগে বলুন, এটি কি করে হলো? তিনি বললেন: কোন ব্যাপারটি? প্রশ্নকর্তা বললেন: সরকারীভাবে সবাইকে যেটুকু করে কাপড় দেয়া হয়েছে তাতে আমাদের তো এতো বড় জামা হয়নি – যেটি আপনি আজ পড়ে এসেছেন? তখন খলিফার ছেলেকে দাঁড়িয়ে এটি ব্যাখ্যা দিতে হয়েছিল যে, তিনি তাঁর ভাগের কাপড়টি তাঁর বাবাকে দেয়ায় জামাটি ওরকম বড় হয়েছে। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী খলিফা উমরের কাছে ঐ কৈফিয়ত চাওয়ার মতো ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর হয়েছে কিনা তা চিন্তা করে দেখার বিষয়! সুতরাং, মত প্রকাশ বা বাক স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে, যা খুশি তাই বললাম। সব কিছুরই একটা সীমারেখা আছে। আর সব পাত্রে সব কিছু ঢালাও যায় না। মানুষের দোষ-ক্রুটিকে ততক্ষণ পর্যন্ত গোপন রাখা যায় যতক্ষণ পর্যন্ত তা অন্যের হক নষ্ট না করে।